Archive for 2016-08-28
বসুন্ধরায় দুইবার আগুন লাগার কথা কেন জানাতে পারলেন না প্রতারক লিটন দেওয়ান?
By : RABBY
বসুন্ধরা শপিং মলে বসে ভবিষ্যৎ জানানোর ফেরীওয়ালা বসুন্ধরায় দুইবার আগুন লাগার কথা কেন জ্যোতিষী লিটন দেওয়ান জানাতে পারেনি তা জানতে চেয়েছেন নায়িকা সাদিয়া আফরিন। তিনি একটি ভিডিও শেয়ার করে এই প্রশ্ন তুলেন। তিনি জানান তার আত্নীয়ের প্রতারিত হওয়ার গল্প।
নায়িকা সাদিয়া আফরিন তার ফেইসবুক ষ্ট্যাটাসে লেখেন, ” বসুন্ধরায় আগুন লাগলো হারামীটা কোথায় ছিল ???
জ্যোতিষ রাজ নামের বাটপারটাকে অনেকেই চেনেন। পত্রিকায় প্রায়ই বিজ্ঞাপন দেন। উনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব বলে দেন। চেম্বার বসুন্ধরা সিটিতে।
বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগলো কয়েক বার – একবারও বাটপারের বাচ্চাটা ভবিষ্যৎ বাণী করতে পারলেন না কেন ???
আমি ২০১২ সালে তার চেম্বারে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করেছিলাম বলেন, আমি কেন এসেছি
আপনার কাছে? বলেছিলেন, আমি বড় রকম সমস্যায় পরেছি তাই ওনার শরানাপন্ন্ হয়েছি।
উত্তরে আমি বলেছিলাম আমার এক কাজিনের থেকে প্রতারনা করে পাথর দিয়ে ৫৫০০০ টাকা নিয়েছিলেন তা ফেরৎ নিতে। শুনে প্রথমে রেগে গিয়েছসুনে, পরে টাকা ফেরৎ ঠিক দিয়েছিলেন এই বাটপার।
লাইসেন্স করে প্রতিদিন মানুষের সাথে প্রতারনা করে যাচ্ছেন এই রকম অনেক বাটপার।
সরকারের কি কিছুই করার নেই ???”
কে এই লিটন দেওয়ান?
যার ছিল ছন্নছাড়া জীবন। নুন আনতে পান্তা ফুরাত। তিনিই এখন অঢেল সম্পত্তির মালিক। দিনমজুরি করে যখন সংসার চলত না, তখন তিনি বেছে নেন বাসের হেলপারি। কিন্তু এ কাজ করেও তার স্বস্তি হচ্ছিল না। তখন তিনি ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে বেছে নেন ঝাড়ফুঁক আর কবিরাজির পথ। এর কয়েক বছরের মধ্যে গ্রামের হতদরিদ্র ছেলে লিটন বনে যান খোদ রাজধানীর সেরা জ্যোতিষরাজ। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার কাহিনীর মতো রাতারাতি পরিণত হন বড় এক ধনকুবের।
হাত দেখে পাথর ধরিয়ে দেয়া হয়। বিনিময়ে হাতিয়ে নেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। যার হিসাব নিজেও রাখতে পারেন না। তাই চেম্বারে তাকে রাখতে হয়েছে একাধিক কর্মচারী। অথচ এই লিটন দেওয়ানই র্যাবের অপরাধ তথ্যভাণ্ডারে (ক্রিমিনাল ডাটাবেজ) একজন পেশাদার প্রতারক। গ্রেফতার হয়ে যিনি প্রতারণার সব তথ্য ফাঁস করে দেন। কিন্তু জেলের ভাত তাকে বেশিদিন খেতে হয়নি। বিচিত্র দেশ। জেলখাটা এ প্রতারকের সঙ্গে ছবি তুলেছেন সমাজের বহু নামিদামি ব্যক্তি। আর গত ৭ বছরে ধরে দিব্যি তিনি বহাল-তবিয়তে হাইপ্রোফাইল চেম্বার খুলে চুটিয়ে প্রতারণার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
লিটন দেওয়ানের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার কুকুটিয়া ইউনিয়নের বাগবাড়ি গ্রামে। তার পিতার নাম মৃত আবদুর সাত্তার দেওয়ান। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। দেশ স্বাধীনের আগে লিটন দেওয়ানের বাবা দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে ফেরি করে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের টানাটানি বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে পেটের তাগিদে লিটন দিনমজুরি শুরু করেন। কিন্তু দ্রুত ধনী হওয়ার জন্য তার মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা ও জিদ কাজ করত। গ্রামের সমবয়সী লোকজনের কাছে তিনি প্রায় তার এমন মনোবাসনার কথা বলতেন।
স্থানীয়রা জানান, বেশি টাকা আয় করার জন্য ১০-১৫ বছর আগে তিনি এলাকা ছেড়ে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে গাড়ির গ্যারেজে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনে হেলপার (চালকের সহকারী) হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরিবহন শ্রমিক হিসেবে কাজ করার একপর্যায়ে রাজধানীর পল্টন এলাকায় ফুটপাতে বসা ল্যাংড়া আমিন নামের এক জ্যোতিষের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। তার নজর পড়ে বিনা পুঁজির এই লোভনীয় ব্যবসার প্রতি। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তার কাছ থেকে কিছু কৌশলও রপ্ত করে নেন তিনি। এরপর নিজেই ফুটপাতে বসে পড়েন। নিজেকে জ্যোতিষ শাস্ত্রের গুরু দাবি করে লিটন দেওয়ান পাথর ব্যবসা শুরু করেন।
অবস্থার একটু উন্নতি হলে রাজধানীর পলওয়েল মার্কেটের ৫ম তলায় জ্যোতিষ চর্চার আস্তানা খুলে বসেন। কিন্তু লিটনের হাতে প্রতারিত হওয়ার বিভিন্ন অভিযোগ আসতে থাকলে পলওয়েল মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা তাকে মার্কেট থেকে বের করে দেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা লিটন দেওয়ান হাল ছাড়েননি। কাকরাইলের ভূঁইয়া ম্যানশনে খুলে বসেন চেম্বার। সেখানে তিনি একটি কৌশলের আশ্রয় নেন। কিছু বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে তাদের দিয়ে উপকার পাওয়ার গল্প ছড়াতে শুরু করেন। নতুন কোনো কাস্টমার এলেই এ চক্র লিটন দেওয়ানের গুণগান শোনাতেন। এভাবে দ্রুত তার এই প্রতারণা ব্যবসার প্রসার ঘটে। ঝড়ে বক পড়ে, আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে এমন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি উঠে আসেন অভিজাত এক বিপণিবিতানে।
১০-১৫ বছর আগেও লিটন দেওয়ানসহ তার অন্য ভাইয়েরা সবাই দিনমজুর ছিলেন। ঢাকায় গিয়ে নিজেকে বড় মাপের জ্যোতিষ জাহির করার পর গ্রামে তার পিতার কবরকেও পীরের মাজার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে তার বড় ভাই শহিদুল ইসলাম পিতার মাজারের খাদেম সেজে তাবিজ-কবচ ও পাথর বিক্রি করেন। অন্য দুই ভাই দুলাল দেওয়ান ও রিপন দেওয়ান রাজধানীতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক পদে চাকরি করেন।
এলাকাবাসী জানান, লিটন দেওয়ান প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডিও পার হননি। অবশ্য লিটন দেওয়ান দাবি করেন তিনি স্থানীয় রুসদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রিও নিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রুসদী প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি কাজী আজিজুল হক বলেন, আমি তো ওই স্কুলের শিক্ষক ছিলাম। তিনি আমার ছাত্র ছিলেন বলে মনে পড়ে না। লিটন দেওয়ানের পিতা পীর সাহেব ছিলেন কিনা জানতে চাইলে কাজী আজিজুল হক বলেন, না তিনি কখনই পীর সাহেব ছিলেন না। তার মৃত্যুর পর লিটন দেওয়ান ঢাকা থেকে লোকজন নিয়ে এসে ওরস না কি যেন পালন করে।
এ বিষয়ে এলাকাবাসীর কোনো আগ্রহই নেই। এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি জিয়াউদ্দীন বলেন, আমি লিটন দেওয়ানকে তো বটেই তার পিতাকেও ঘনিষ্ঠভাবে চিনতাম। তিনি একজন দরিদ্র ও দুস্থ ব্যক্তি ছিলেন। তার ছেলে লিটন দেওয়ান জ্যোতিষগিরি করে প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক বনে গেছেন। এসব নিয়ে এলাকায় অনেক কথাবার্তা প্রচলিত আছে। শুনেছি লিটন দেওয়ান সম্প্রতি হীরার (ডায়মন্ড) ব্যবসা শুরু করেছেন। এলাকায় অনেকে লিটন দেওয়ানকে প্রতারক ও ভণ্ড বলে জানে।
বিশাল বিত্তবৈভব : সূত্র বলছে, প্রতারণার মাধ্যমে লিটন দেওয়ান বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। তার সম্পদের খোঁজ করতে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে কারও উপায় নেই। রাজধানীর একটি একটি অভিজাত বিপণিবিতানে তার মালিকানাধীন দোকান রয়েছে অন্তত ১৫টি। এর মধ্যে ৬টি দোকানের ঠিকানা পাওয়া গেছে। এগুলো হল লেভেল-১ এর ডি ব্লকের ৭০, ৭১, ৭৩, ৭৪, ৮৭ ও ১০০ নম্বর দোকান।
এসব দোকানে রয়েছে লিটন দেওয়ানের পাথর, সুগন্ধিসহ নানা ধরনের পণ্যের শোরুম। প্রতিটি দোকানের দাম অন্তত দেড় কোটি টাকা। লিটন দেওয়ান আগে পাজেরো জিপে চলাফেরা করতেন। এখন চড়েন দামি ব্যান্ডের প্রাইভেট কারে। সূত্র বলছে, লিটন দেওয়ান রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২০টি ফ্ল্যাটের মালিক। রাজধানীর ৩, চামেলীবাগে একটি বহুতল অ্যাপার্টমেন্টে লিটনের ৫টি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে।
বর্তমানে এসব ফ্ল্যাটের প্রতিটির মূল্য অন্তত ৮০ লাখ টাকা। বিশ বছর আগেও ভিটেবাড়ি ছাড়া কোনো সম্পদ না থাকলেও বর্তমানে লিটন দেওয়ান তার পরিবারের সদস্যদের নামে শ্রীনগরে পাঁচ একর কৃষি জমি কিনেছেন। তার পিতার কবরেও বিশাল মাজার কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হয়েছে।
তালিকাভুক্ত অপরাধী : র্যাবের অপরাধী তথ্যভাণ্ডারে (ক্রিমিনাল ডাটাবেজ) লিটন দেওয়ানের নাম রয়েছে। তথ্যভাণ্ডারের তথ্য অনুযায়ী লিটন দেওয়ান একজন পেশাদার প্রতারক। তার সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য হচ্ছে, লিটন দেওয়ানের উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। গায়ের রং ফর্সা, সুশ্রী ও মায়াবী চেহারা। চোখের রং কালো। বর্তমান বয়স (২০০৭ সালে রেকর্ডকৃত) ৪৫ বছর।
র্যাবের ডাটাবেজে বলা হয়েছে, লিটন দেওয়ানের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। তবে সময় ও আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলমান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংগতি রেখে চলেন। তিনি বিবাহিত এবং বাংলা ভাষায় শুধু ভাষা জ্ঞান রয়েছে। ঢাকায় তার ঠিকানা কাকরাইলের ইস্টার্ন পার্ক অ্যাপার্টমেন্ট। তার প্রধান সহযোগীর নাম জাহাঙ্গীর আলম। পিতার নাম আবদুর রাজ্জাক মোল্লা। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থানার বারাংকোলা।
আরও দুই সহযোগীর একজন হলেন শামীম। পিতা আলী আজম হাওলাদার। স্থায়ী ঠিকানা বরিশাল জেলার বাখেরগঞ্জ থানার কাশিনা গ্রাম। অপরজনের নাম সারোয়ার। তবে সারোয়ারের সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। র্যাবের তথ্যভাণ্ডারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে লিটন দেওয়ানকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে রমনা থানায় নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনে পৃথক দুটি মামলা রয়েছে (মামলা নং ২৯ ও ৩০)।
লিটন দেওয়ানের বক্তব্য : প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ খণ্ডন করে তিনি বলেন, সব সম্পদ নিয়ম অনুযায়ী তার আয়কর ফাইলে প্রদর্শিত। বৈধ ব্যবসা করেই এসব সম্পদ অর্জন করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও তার প্রতি ভক্তদের বিশ্বাস এতটুকুও কমেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে বেড়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে তিনি বলেন, জ্যোতিষ শাস্ত্রের সাধনা লেখাপড়া করে হয় না। এটা সাধনার বিষয়। দীর্ঘ সাধনার মাধ্যমে তিনি জ্যোতিষ হিসেবে খ্যাতি ও দক্ষতা অর্জন করেছেন। তার দাবি, কোনোকালেই তিনি পরিবহন শ্রমিক ছিলেন না।
একেবারে অজোপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা এক সময়ের অখ্যাত মানুষটি এখন বিলাসবহুল চেম্বার খুলে বসেছেন খোদ রাজধানীতে। একটি অভিজাত স্বনামধন্য বিপণিবিতানে রয়েছে তার জ্যোতিষশাস্ত্রের দফতর। এটি আবার সব মুসকিল আসান দফতর নামেও পরিচিত। কেউ কেউ বলেন, জিন্দা পীরের দরবার। ভক্তদের কেউ আবার পাগলা বাবার দরবার বলতেও পছন্দ করেন।
কিন্তু নাম যাই হোক না কেন, কাজ নিয়ে রয়েছে ভয়াবহ সব তথ্য ও প্রমাণ। এখানে মূলত মানুষের ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে লিটন দেওয়ান রীতিমতো বিখ্যাত উপন্যাস ‘লালসালুর’ কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদের মতো ‘মাজার’ খুলে বসেছেন। নিজেকে বিখ্যাত জ্যোতিষবিদ দাবি করে দু’হাতে খালি করে চলেছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের পকেট। আবার সম্মানের ভয়ে মুখ না খুললেও বহু নারী তার হাতে বিপজ্জনক শিকারে পরিণত হয়েছেন।
তথ্যপ্রমাণসহ লিটন দেওয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি আসলে একজন ভণ্ড এবং প্রতারক। প্রতারণাই তার আসল ব্যবসা। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে তিনি সহজ সরল মানুষকে বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। আর টাকার জোরে আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখেও ধুলো দিতে সক্ষম হয়েছেন।
লিটনের আখড়ায় সরেজমিন : বড় অংকের লটারি ও চাকরি পাইয়ে দেয়া, মামলায় জেতানো, ভালো লাগার মানুষ ও পরস্ত্রীকে বশে আনা, বিদেশ যেতে বাধা দূর করাসহ সব ধরনের সমস্যার সমাধান দেন লিটন দেওয়ান। এক কথায়, এমন কোনো সমস্যা নেই যার সমাধান লিটনের কাছে নেই। খবরের কাগজে ও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দিনরাত মিথ্যার বেসাতির মতো লিটন দেওয়ানের গুণগান ও মহত্ত্বকথা ছড়িয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। লিটনের সাক্ষাৎকার ছাপানো হচ্ছে অখ্যাত বিভিন্ন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনেও। আবার শুধু টাকার জন্য এই প্রতারকের বিজ্ঞাপনে মডেল হতে দেখা গেছে নামিদামি অভিনেতাকেও।
বেলা তখন সাড়ে ১২টা। দেখা গেল, ডাক্তারের ফি’র মতো লিটন দেওয়ানের কর্মচারীরা সাক্ষাৎপ্রার্থীদের নাম খাতায় এন্ট্রি করে প্রত্যেকের কাছ থেকে আগাম ফি নিচ্ছেন। জনপ্রতি ৫শ’ টাকা। ওই ভরদুপুরে সিরিয়াল নম্বর ৭৫ । ‘৭৬ নম্বরে সিরিয়ালে সাক্ষাৎ পেতে হলে রাত ১১টাও বেজে যেতে পারে।’ তাই বাধ্য হয়ে ভিন্ন উপায়ে সিরিয়াল কমিয়ে ৫৪ করা হল। এবার দীর্ঘ অপেক্ষা।
লিটন বসে আছেন কাচঘেরা বিশেষ একটি সুসজ্জিত কক্ষে। অনুমতি ছাড়া সেখানে প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ। সমস্যাগ্রস্ত বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ চেম্বারের বাইরে অপেক্ষমাণ। আগে-পরে ঢোকা নিয়ে দর্শনার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় রীতিমতো ঝগড়া হচ্ছে। ঝগড়া সামাল দিচ্ছেন লিটনের ব্যক্তিগত কর্মচারীরা। একজন নারী দর্শনার্থী লিটন দেওয়ানের ব্যক্তিগত কর্মচারীদের উদ্দেশ করে বলেন, গত মাসেও এসেছিলাম। কিন্তু ভিড়ের কারণে ‘বাবার’ সাক্ষাৎ পাইনি। এবার একটু তাড়াতাড়ি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। এ অনুরোধ শুনে একজন কর্মচারী রীতিমতো কড়া ধমক দেন। বলেন, দেখছেন না কত ভিড়। আপনাকে আগে পাঠালে অন্যরা কি বলবে। চুপচাপ বসে থাকেন। সিরিয়াল এলে তবেই ভেতরে ঢুকতে পারবেন। ধমক খেয়ে চুপ করে যান ওই নারী।
মুন্সীগঞ্জ থেকে এক নবদম্পতি এসেছেন লিটনের সাক্ষাৎ পেতে। সমস্যা জানতে চাইলে তারা জানালেন, মাত্র এক বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে সুখী নন। নানা সমস্যা হচ্ছে। জিন-পরীর কুনজর পড়েছে মনে করে তারা ‘লিটন বাবা’র কাছে ‘তদ্বির’ নিতে এসেছেন। আরেকজন কানাডা প্রবাসী নারী দর্শনার্থী এসেছেন। পরকীয়ার কারণে তার সংসার ভেঙে যাচ্ছে। প্রতিকার পেতে তিনি বাবার আস্তানায় এসেছেন। একজন ব্যবসায়ী এসেছেন তার ব্যবসা ভালো করার তদবির নিতে। লিটন দেওয়ান এসব দর্শনার্থীর কাছ থেকে একের পর এক এসব সমস্যার কথা শুনে সমানে সরকারি হাসপাতালের প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দেয়ার মতো পাথর, আংটি ও তাবিজ দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, ১০০ পার্সেন্ট গ্যারান্টি। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সন্ধ্যা ৭টায় ৫৪ নম্বর সিরিয়ালের ডাক পড়ল।চেম্বারের ভেতরে লিটন দেওয়ানের মুখোমুখি । কিন্তু তার কক্ষে ঢুকে অনেকটা বিস্মিত হতে হল। ঘরময় নানা ধরনের পুরস্কার, ক্রেস্ট আর মন্ত্রী-এমপিসহ গণমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে লিটনের তোলা ছবি দিয়ে সাজসাজ অবয়ব। ঘরে বড় করে টানানো আছে আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লিটনকে দেয়া সম্মাননা, ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট। বিশাল এক বিলাসবহুল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন কথিত জ্যোতিষ রাজ লিটন। পরনে সবুজ রংয়ের পাঞ্জাবি। মাথায় কালো টুপি। কক্ষের ভেতরে ঢোকামাত্র বিশেষ ভঙ্গিতে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তিনি। ইশারায় বসতে বললেন। সালাম ও নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিটন দেওয়ানকে বলা হল, ‘চাকরির বয়স শেষ। যেভাবেই হোক এবার বিসিএস পরীক্ষায় চান্স পাওয়াতেই হবে। সমস্যা শুনে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেললেন লিটন। বললেন, তোর সমস্যা অনেক জটিল। তবে আমি সবাধান দেয়ার অছিলা মাত্র। সব সমাধান দেবেন (উপরের দিকে একটা আঙুল তুলে) তিনি। কোথায় থাকি, নাম পরিচয়, বাবার নাম ইত্যাদি জানতে চাইলেন। এরপর রাশি নির্ধারণের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে আতশি কাচ দিয়ে উল্টেপাল্টে হাত দেখলেন। এরপর বললেন, শনির রাহু গ্রাস করেছে। রাহু কাটাতে নীলার (পাথর) আংটি পরতে হবে। আংটির দাম ১৫ হাজার টাকা। এই আংটি পরলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’
এরপর আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসতেই বাইরে থাকা লিটনের কর্মচারীরা ঘিরে ধরলেন। তাদের বক্তব্য-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ, এখন টাকা দেন, পাথরের আংটি নিয়ে যান।’ এত টাকা সঙ্গে নেই জানিয়ে কিছুক্ষণ পরে আসার কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা গেল।
জানা গেল, প্রতিদিন লিটন দেওয়ানের কাছে গড়ে দেড়শ’ সমস্যাপীড়িত মানুষ সাক্ষাৎ করতে আসেন। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫শ’ টাকা করে শুধু দর্শনী ফি বাবদ দৈনিক আদায় করা হয় ৭৫ হাজার টাকা। মাসের হিসাবে এই অংক সাড়ে ২২ লাখ। বছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় তিন কোটি টাকা। লিটন নিজেই বলেছেন, ৩০ বছর ধরে এই ব্যবসা করছেন তিনি।
প্রলোভনের বিজ্ঞাপন : লিটন দেওয়ানের বিজ্ঞাপনে অনেক নামিদামি চিত্রতারকারা বলেন, তারা ‘দেওয়ান সাহেব’র কাছে এসে উপকৃত হয়েছেন। তাদের অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে।’ এসব চিত্রতারকার মধ্যে আছেন শীর্ষস্থানীয় চিত্রপরিচালক কাজী হায়াৎ, খল অভিনেতা আহমেদ শরীফ, চিত্র নায়িকা রত্না, অভিনেত্রী খালেদা আক্তার, রিনা খান, চিত্রনায়ক হেলাল খান ও অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী।
বিজ্ঞাপন দৃশ্যে চিত্রনায়ক হেলাল খানকে বলতে দেখা যায়, ‘আমাকে উনি (লিটন দেওয়ান) একটা পাথরের আংটি দিয়েছেন। আমি উপকার পেয়েছি। আপনারাও আসুন, আমার মনে হয় উপকার পাবেন।’ বিশিষ্ট অভিনেত্রী রিনা খান বিজ্ঞাপনে বলছেন, ‘জ্যোতিষরাজ লিটন দেওয়ানের কাছ থেকে এই পাথর কিনে ব্যবহার করি। এই পাথর ব্যবহার করার পরে আমার জীবনে সুখশান্তি ফিরে আসে। আপনারাও এই পাথর ব্যবহার করুন। এই পাথর আসল পাথর। জ্যোতিষরাজ লিটন দেওয়ান মানুষের মুখ দেখেই তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন।’ বর্ষীয়ান অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরীকে বিজ্ঞাপনে বলতে দেখা যায়, ‘কোন সমস্যায় কি সমাধান দিতে হবে এটাই তার সাধনা। আপনার সমস্যাগুলো তাকে বলুন। নিশ্চয় আপনি উপকৃত হবেন।’ চিত্রপরিচালক কাজী হায়াৎকে বলতে দেখা যায়, ‘লিটন দেওয়ান একজন নামকরা জ্যোতিষ। তার কাছ থেকে একটি পাথর নিলাম। দেওয়ান সাহেব বললেন, আপনি এই পাথরটি পরবেন। আপনার জীবনে সাফল্য আসবে।’ চিত্র নায়িকা রত্নাকে বলতে দেখা যায়, ‘আমি আমার জীবনের নানা সমস্যা উনাকে (লিটন দেওয়ান) বললাম। সব শুনে তিনি আমাকে দুটি আংটি দিলেন। আংটি দুটি আমি ব্যবহার করছি। এখন আমি অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছি।’ খল অভিনেতা আহেমদ শরীফ বলছেন, লিটন দেওয়ান একজন গুণী ব্যক্তি। তার পিতাও একজন বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। তার পিতার মাজার শরিফের ঔরস অনুষ্ঠানে আমি নিজে যাই। আপনারাও যাবেন। লিটন দেওয়ানের কাছে এসে আমি উপকৃত হয়েছি।’ বিজ্ঞাপন চিত্রে ঢাকায় চলচ্চিত্রের একজন বর্ষীয়ান অভিনেতাকে পাথরের আংটিতে চুমু দিতে দিতে লিটন দেওয়ানের কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। বিজ্ঞাপনের আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, লিটন দেওয়ান একজন সুন্দরী তরুণীর হাত ধরে তার মুখের দিকে চেয়ে বসে আছেন। এ সময় ওই তরুণীকেও লিটন দেওয়ানের দিকে তাকিয়ে রোমান্টিক ভঙ্গিতে হাসতে দেখা যায়।
যা বললেন অভিনেতারা : এসব চিত্র অভিনেতা কি সত্যি উপকার পেয়ে এসব কথা বলছেন? নাকি শুধু টাকার জন্য শেখানো কথাগুলো ক্যামেরার সামনে মডেল হিসেবে অভিনয় করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী বলেন, অভিনয়ই তার পেশা। তবে একটা মান বজায় রেখেই তিনি অভিনয় করেন। লিটন দেওয়ানের বিজ্ঞাপনেও তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অভিনয় করেছেন মাত্র। কিন্তু অভিনয়ের সময় তারা তাকে দিয়ে যা বলাতে চেয়েছিল তার সবকিছু তিনি বলেননি। যেটুকু যৌক্তিক মনে করেছেন সেটুকুই বলেছেন।
অভিনেত্রী রীনা খানের কাছে একই বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি অভিনেত্রী। অভিনয় করাই আমার কাজ। তবে এই বিজ্ঞাপনে তিনি একা নন, আরও অনেকে অভিনয় করেছেন। এ বিষয়টাতে সবাই যে বক্তব্য দেবেন তারও একই বক্তব্য। অভিনেতা হেলাল খান এখন কারাগারে আছেন। তাই তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। চিত্রনায়িকা রত্না প্রশ্নের উত্তরে কোনো সাড়া দেননি। বিদেশে অবস্থান করায় পরিচালক কাজী হায়াতের মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
গ্রেফতারের পর স্বীকারোক্তি : প্রতারণার অভিযোগে ২০০৮ সালের ১৪ আগস্ট লিটন দেওয়ানকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় জাহাঙ্গীর আলম ও শামীম নামের লিটন দেওয়ানের দুই সহযোগীকেও গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়ার পর নিজের সব অপরাধের কথা অকপটে স্বীকার করেন লিটন দেওয়ান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জ্যোতিষ লাইনটা, এই যে পীর ফকিরী এইটা ভণ্ডামি। যারাই করতাছে সব ভণ্ডামি। আমরাও ভুলের কারণে জড়াইয়া গেছিলাম।’ চিকিৎসার জন্য আসা নিঃসন্তান নারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নিঃসন্তান মহিলারা আমাদের কাছে কম আসে। তবে বিভিন্ন বয়সী মহিলারা আমাদের কাছে আসে। অনেক সময় আমাদের সান্নিধ্য পেতেও চায়। আমরাও লোভ-লালসায় জড়ায়ে যাই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই লাইন ছেড়ে দেব। আমি অনুতপ্ত।’ র্যাব-৩ এর তৎকালীন অধিনায়ক উইং কমান্ডার সুলতান মাহমুদ নূরানী সে সময় সাংবাদিকদের জানান, আধ্যাত্মিক শক্তির দাবিদার এই প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছে বহু মানুষ। সে অলৌকিক নানা শক্তি প্রদর্শন করতে পারে বলে প্রচার করত। বলা হতো, তার ঘরের ছাদের ওপর থেকে রক্তের ফোঁটা পড়ে। পরে তাদের তদন্তে দেখা গেল, সে বিশেষ কৌশলে কেমিক্যাল দিয়ে এসব প্রতারণার আশ্রয় নিত।
এদিকে তার প্রতারণার বিষয়ে অনুসন্ধান চলাকালে ১৯ মার্চ লিটন দেওয়ান ফোন করে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘ভাই, নিউজ টিউজ কইর্যা কি হইব? আমি তো একা খাই না। সবাই মিল্ল্যা জুল্ল্যা খাই। একদিন আমার অফিসে আসেন। চা খান।’
বক্তব্য : ১৮ মার্চ লিটন দেওয়ান তার কার্যালয়ে বসে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তিনি এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। প্রতারণা বা ভণ্ডামি করলে তিনি এতদিন টিকে থাকতে পারতেন না। তবে এ দীর্ঘ সময়ে তাকে র্যাব, পুলিশের নানা ধরনের ঝামেলা সহ্য করতে হয়েছে। তিনি দাবি করেন ২০০৮ সালে র্যাব তাকে অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করে। অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ না থাকায় মাত্র ১৬ দিনের মাথায় তিনি জামিনও পান। দায়েরকৃত মামলাও আদালতে প্রমাণিত হয়নি। সব অভিযোগ থেকে তিনি সম্পূর্ণ খালাস পেয়েছেন। টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা তার ব্যবসা। ব্যবসার প্রচার-প্রসার বাড়ানোর জন্য সবাই যেভাবে বিজ্ঞাপন দেয় তিনিও তাই দিচ্ছেন। এটা অন্যায়ের কিছু নয়। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা এভাবে প্রদর্শন করার মধ্যে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা আমাকে হাত দেখিয়েছে তাদের সঙ্গেই আমার ছবি আছে। এতে প্রতারণার কিছু নেই।
কথিত জ্যোতিষরাজ লিটন দেওয়ানের প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, এ ধরনের জ্যোতিষ, জিনের বাদশাকে র্যাব বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করেছে। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে সহজেই তারা জামিনে বেরিয়ে যায়। প্রতারকদের চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট না হতে সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের প্রতারকদের হাতে যারা প্রতারিত হয়েছেন তারা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেবে র্যাব।
হাত দেখে পাথর ধরিয়ে দেয়া হয়। বিনিময়ে হাতিয়ে নেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। যার হিসাব নিজেও রাখতে পারেন না। তাই চেম্বারে তাকে রাখতে হয়েছে একাধিক কর্মচারী। অথচ এই লিটন দেওয়ানই র্যাবের অপরাধ তথ্যভাণ্ডারে (ক্রিমিনাল ডাটাবেজ) একজন পেশাদার প্রতারক। গ্রেফতার হয়ে যিনি প্রতারণার সব তথ্য ফাঁস করে দেন। কিন্তু জেলের ভাত তাকে বেশিদিন খেতে হয়নি। বিচিত্র দেশ। জেলখাটা এ প্রতারকের সঙ্গে ছবি তুলেছেন সমাজের বহু নামিদামি ব্যক্তি। আর গত ৭ বছরে ধরে দিব্যি তিনি বহাল-তবিয়তে হাইপ্রোফাইল চেম্বার খুলে চুটিয়ে প্রতারণার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
লিটন দেওয়ানের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার কুকুটিয়া ইউনিয়নের বাগবাড়ি গ্রামে। তার পিতার নাম মৃত আবদুর সাত্তার দেওয়ান। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। দেশ স্বাধীনের আগে লিটন দেওয়ানের বাবা দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে ফেরি করে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের টানাটানি বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে পেটের তাগিদে লিটন দিনমজুরি শুরু করেন। কিন্তু দ্রুত ধনী হওয়ার জন্য তার মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা ও জিদ কাজ করত। গ্রামের সমবয়সী লোকজনের কাছে তিনি প্রায় তার এমন মনোবাসনার কথা বলতেন।
স্থানীয়রা জানান, বেশি টাকা আয় করার জন্য ১০-১৫ বছর আগে তিনি এলাকা ছেড়ে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে গাড়ির গ্যারেজে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনে হেলপার (চালকের সহকারী) হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরিবহন শ্রমিক হিসেবে কাজ করার একপর্যায়ে রাজধানীর পল্টন এলাকায় ফুটপাতে বসা ল্যাংড়া আমিন নামের এক জ্যোতিষের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। তার নজর পড়ে বিনা পুঁজির এই লোভনীয় ব্যবসার প্রতি। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তার কাছ থেকে কিছু কৌশলও রপ্ত করে নেন তিনি। এরপর নিজেই ফুটপাতে বসে পড়েন। নিজেকে জ্যোতিষ শাস্ত্রের গুরু দাবি করে লিটন দেওয়ান পাথর ব্যবসা শুরু করেন।
অবস্থার একটু উন্নতি হলে রাজধানীর পলওয়েল মার্কেটের ৫ম তলায় জ্যোতিষ চর্চার আস্তানা খুলে বসেন। কিন্তু লিটনের হাতে প্রতারিত হওয়ার বিভিন্ন অভিযোগ আসতে থাকলে পলওয়েল মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা তাকে মার্কেট থেকে বের করে দেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা লিটন দেওয়ান হাল ছাড়েননি। কাকরাইলের ভূঁইয়া ম্যানশনে খুলে বসেন চেম্বার। সেখানে তিনি একটি কৌশলের আশ্রয় নেন। কিছু বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে তাদের দিয়ে উপকার পাওয়ার গল্প ছড়াতে শুরু করেন। নতুন কোনো কাস্টমার এলেই এ চক্র লিটন দেওয়ানের গুণগান শোনাতেন। এভাবে দ্রুত তার এই প্রতারণা ব্যবসার প্রসার ঘটে। ঝড়ে বক পড়ে, আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে এমন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি উঠে আসেন অভিজাত এক বিপণিবিতানে।
১০-১৫ বছর আগেও লিটন দেওয়ানসহ তার অন্য ভাইয়েরা সবাই দিনমজুর ছিলেন। ঢাকায় গিয়ে নিজেকে বড় মাপের জ্যোতিষ জাহির করার পর গ্রামে তার পিতার কবরকেও পীরের মাজার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে তার বড় ভাই শহিদুল ইসলাম পিতার মাজারের খাদেম সেজে তাবিজ-কবচ ও পাথর বিক্রি করেন। অন্য দুই ভাই দুলাল দেওয়ান ও রিপন দেওয়ান রাজধানীতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক পদে চাকরি করেন।
এলাকাবাসী জানান, লিটন দেওয়ান প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডিও পার হননি। অবশ্য লিটন দেওয়ান দাবি করেন তিনি স্থানীয় রুসদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রিও নিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রুসদী প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি কাজী আজিজুল হক বলেন, আমি তো ওই স্কুলের শিক্ষক ছিলাম। তিনি আমার ছাত্র ছিলেন বলে মনে পড়ে না। লিটন দেওয়ানের পিতা পীর সাহেব ছিলেন কিনা জানতে চাইলে কাজী আজিজুল হক বলেন, না তিনি কখনই পীর সাহেব ছিলেন না। তার মৃত্যুর পর লিটন দেওয়ান ঢাকা থেকে লোকজন নিয়ে এসে ওরস না কি যেন পালন করে।
এ বিষয়ে এলাকাবাসীর কোনো আগ্রহই নেই। এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি জিয়াউদ্দীন বলেন, আমি লিটন দেওয়ানকে তো বটেই তার পিতাকেও ঘনিষ্ঠভাবে চিনতাম। তিনি একজন দরিদ্র ও দুস্থ ব্যক্তি ছিলেন। তার ছেলে লিটন দেওয়ান জ্যোতিষগিরি করে প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক বনে গেছেন। এসব নিয়ে এলাকায় অনেক কথাবার্তা প্রচলিত আছে। শুনেছি লিটন দেওয়ান সম্প্রতি হীরার (ডায়মন্ড) ব্যবসা শুরু করেছেন। এলাকায় অনেকে লিটন দেওয়ানকে প্রতারক ও ভণ্ড বলে জানে।
বিশাল বিত্তবৈভব : সূত্র বলছে, প্রতারণার মাধ্যমে লিটন দেওয়ান বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। তার সম্পদের খোঁজ করতে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে কারও উপায় নেই। রাজধানীর একটি একটি অভিজাত বিপণিবিতানে তার মালিকানাধীন দোকান রয়েছে অন্তত ১৫টি। এর মধ্যে ৬টি দোকানের ঠিকানা পাওয়া গেছে। এগুলো হল লেভেল-১ এর ডি ব্লকের ৭০, ৭১, ৭৩, ৭৪, ৮৭ ও ১০০ নম্বর দোকান।
এসব দোকানে রয়েছে লিটন দেওয়ানের পাথর, সুগন্ধিসহ নানা ধরনের পণ্যের শোরুম। প্রতিটি দোকানের দাম অন্তত দেড় কোটি টাকা। লিটন দেওয়ান আগে পাজেরো জিপে চলাফেরা করতেন। এখন চড়েন দামি ব্যান্ডের প্রাইভেট কারে। সূত্র বলছে, লিটন দেওয়ান রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২০টি ফ্ল্যাটের মালিক। রাজধানীর ৩, চামেলীবাগে একটি বহুতল অ্যাপার্টমেন্টে লিটনের ৫টি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে।
বর্তমানে এসব ফ্ল্যাটের প্রতিটির মূল্য অন্তত ৮০ লাখ টাকা। বিশ বছর আগেও ভিটেবাড়ি ছাড়া কোনো সম্পদ না থাকলেও বর্তমানে লিটন দেওয়ান তার পরিবারের সদস্যদের নামে শ্রীনগরে পাঁচ একর কৃষি জমি কিনেছেন। তার পিতার কবরেও বিশাল মাজার কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হয়েছে।
তালিকাভুক্ত অপরাধী : র্যাবের অপরাধী তথ্যভাণ্ডারে (ক্রিমিনাল ডাটাবেজ) লিটন দেওয়ানের নাম রয়েছে। তথ্যভাণ্ডারের তথ্য অনুযায়ী লিটন দেওয়ান একজন পেশাদার প্রতারক। তার সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য হচ্ছে, লিটন দেওয়ানের উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। গায়ের রং ফর্সা, সুশ্রী ও মায়াবী চেহারা। চোখের রং কালো। বর্তমান বয়স (২০০৭ সালে রেকর্ডকৃত) ৪৫ বছর।
র্যাবের ডাটাবেজে বলা হয়েছে, লিটন দেওয়ানের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। তবে সময় ও আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলমান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংগতি রেখে চলেন। তিনি বিবাহিত এবং বাংলা ভাষায় শুধু ভাষা জ্ঞান রয়েছে। ঢাকায় তার ঠিকানা কাকরাইলের ইস্টার্ন পার্ক অ্যাপার্টমেন্ট। তার প্রধান সহযোগীর নাম জাহাঙ্গীর আলম। পিতার নাম আবদুর রাজ্জাক মোল্লা। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থানার বারাংকোলা।
আরও দুই সহযোগীর একজন হলেন শামীম। পিতা আলী আজম হাওলাদার। স্থায়ী ঠিকানা বরিশাল জেলার বাখেরগঞ্জ থানার কাশিনা গ্রাম। অপরজনের নাম সারোয়ার। তবে সারোয়ারের সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। র্যাবের তথ্যভাণ্ডারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে লিটন দেওয়ানকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে রমনা থানায় নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনে পৃথক দুটি মামলা রয়েছে (মামলা নং ২৯ ও ৩০)।
লিটন দেওয়ানের বক্তব্য : প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ খণ্ডন করে তিনি বলেন, সব সম্পদ নিয়ম অনুযায়ী তার আয়কর ফাইলে প্রদর্শিত। বৈধ ব্যবসা করেই এসব সম্পদ অর্জন করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও তার প্রতি ভক্তদের বিশ্বাস এতটুকুও কমেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে বেড়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে তিনি বলেন, জ্যোতিষ শাস্ত্রের সাধনা লেখাপড়া করে হয় না। এটা সাধনার বিষয়। দীর্ঘ সাধনার মাধ্যমে তিনি জ্যোতিষ হিসেবে খ্যাতি ও দক্ষতা অর্জন করেছেন। তার দাবি, কোনোকালেই তিনি পরিবহন শ্রমিক ছিলেন না।
একেবারে অজোপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা এক সময়ের অখ্যাত মানুষটি এখন বিলাসবহুল চেম্বার খুলে বসেছেন খোদ রাজধানীতে। একটি অভিজাত স্বনামধন্য বিপণিবিতানে রয়েছে তার জ্যোতিষশাস্ত্রের দফতর। এটি আবার সব মুসকিল আসান দফতর নামেও পরিচিত। কেউ কেউ বলেন, জিন্দা পীরের দরবার। ভক্তদের কেউ আবার পাগলা বাবার দরবার বলতেও পছন্দ করেন।
কিন্তু নাম যাই হোক না কেন, কাজ নিয়ে রয়েছে ভয়াবহ সব তথ্য ও প্রমাণ। এখানে মূলত মানুষের ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে লিটন দেওয়ান রীতিমতো বিখ্যাত উপন্যাস ‘লালসালুর’ কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদের মতো ‘মাজার’ খুলে বসেছেন। নিজেকে বিখ্যাত জ্যোতিষবিদ দাবি করে দু’হাতে খালি করে চলেছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের পকেট। আবার সম্মানের ভয়ে মুখ না খুললেও বহু নারী তার হাতে বিপজ্জনক শিকারে পরিণত হয়েছেন।
তথ্যপ্রমাণসহ লিটন দেওয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি আসলে একজন ভণ্ড এবং প্রতারক। প্রতারণাই তার আসল ব্যবসা। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে তিনি সহজ সরল মানুষকে বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। আর টাকার জোরে আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখেও ধুলো দিতে সক্ষম হয়েছেন।
লিটনের আখড়ায় সরেজমিন : বড় অংকের লটারি ও চাকরি পাইয়ে দেয়া, মামলায় জেতানো, ভালো লাগার মানুষ ও পরস্ত্রীকে বশে আনা, বিদেশ যেতে বাধা দূর করাসহ সব ধরনের সমস্যার সমাধান দেন লিটন দেওয়ান। এক কথায়, এমন কোনো সমস্যা নেই যার সমাধান লিটনের কাছে নেই। খবরের কাগজে ও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দিনরাত মিথ্যার বেসাতির মতো লিটন দেওয়ানের গুণগান ও মহত্ত্বকথা ছড়িয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। লিটনের সাক্ষাৎকার ছাপানো হচ্ছে অখ্যাত বিভিন্ন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনেও। আবার শুধু টাকার জন্য এই প্রতারকের বিজ্ঞাপনে মডেল হতে দেখা গেছে নামিদামি অভিনেতাকেও।
বেলা তখন সাড়ে ১২টা। দেখা গেল, ডাক্তারের ফি’র মতো লিটন দেওয়ানের কর্মচারীরা সাক্ষাৎপ্রার্থীদের নাম খাতায় এন্ট্রি করে প্রত্যেকের কাছ থেকে আগাম ফি নিচ্ছেন। জনপ্রতি ৫শ’ টাকা। ওই ভরদুপুরে সিরিয়াল নম্বর ৭৫ । ‘৭৬ নম্বরে সিরিয়ালে সাক্ষাৎ পেতে হলে রাত ১১টাও বেজে যেতে পারে।’ তাই বাধ্য হয়ে ভিন্ন উপায়ে সিরিয়াল কমিয়ে ৫৪ করা হল। এবার দীর্ঘ অপেক্ষা।
লিটন বসে আছেন কাচঘেরা বিশেষ একটি সুসজ্জিত কক্ষে। অনুমতি ছাড়া সেখানে প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ। সমস্যাগ্রস্ত বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ চেম্বারের বাইরে অপেক্ষমাণ। আগে-পরে ঢোকা নিয়ে দর্শনার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় রীতিমতো ঝগড়া হচ্ছে। ঝগড়া সামাল দিচ্ছেন লিটনের ব্যক্তিগত কর্মচারীরা। একজন নারী দর্শনার্থী লিটন দেওয়ানের ব্যক্তিগত কর্মচারীদের উদ্দেশ করে বলেন, গত মাসেও এসেছিলাম। কিন্তু ভিড়ের কারণে ‘বাবার’ সাক্ষাৎ পাইনি। এবার একটু তাড়াতাড়ি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। এ অনুরোধ শুনে একজন কর্মচারী রীতিমতো কড়া ধমক দেন। বলেন, দেখছেন না কত ভিড়। আপনাকে আগে পাঠালে অন্যরা কি বলবে। চুপচাপ বসে থাকেন। সিরিয়াল এলে তবেই ভেতরে ঢুকতে পারবেন। ধমক খেয়ে চুপ করে যান ওই নারী।
মুন্সীগঞ্জ থেকে এক নবদম্পতি এসেছেন লিটনের সাক্ষাৎ পেতে। সমস্যা জানতে চাইলে তারা জানালেন, মাত্র এক বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে সুখী নন। নানা সমস্যা হচ্ছে। জিন-পরীর কুনজর পড়েছে মনে করে তারা ‘লিটন বাবা’র কাছে ‘তদ্বির’ নিতে এসেছেন। আরেকজন কানাডা প্রবাসী নারী দর্শনার্থী এসেছেন। পরকীয়ার কারণে তার সংসার ভেঙে যাচ্ছে। প্রতিকার পেতে তিনি বাবার আস্তানায় এসেছেন। একজন ব্যবসায়ী এসেছেন তার ব্যবসা ভালো করার তদবির নিতে। লিটন দেওয়ান এসব দর্শনার্থীর কাছ থেকে একের পর এক এসব সমস্যার কথা শুনে সমানে সরকারি হাসপাতালের প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দেয়ার মতো পাথর, আংটি ও তাবিজ দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, ১০০ পার্সেন্ট গ্যারান্টি। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সন্ধ্যা ৭টায় ৫৪ নম্বর সিরিয়ালের ডাক পড়ল।চেম্বারের ভেতরে লিটন দেওয়ানের মুখোমুখি । কিন্তু তার কক্ষে ঢুকে অনেকটা বিস্মিত হতে হল। ঘরময় নানা ধরনের পুরস্কার, ক্রেস্ট আর মন্ত্রী-এমপিসহ গণমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে লিটনের তোলা ছবি দিয়ে সাজসাজ অবয়ব। ঘরে বড় করে টানানো আছে আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লিটনকে দেয়া সম্মাননা, ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট। বিশাল এক বিলাসবহুল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন কথিত জ্যোতিষ রাজ লিটন। পরনে সবুজ রংয়ের পাঞ্জাবি। মাথায় কালো টুপি। কক্ষের ভেতরে ঢোকামাত্র বিশেষ ভঙ্গিতে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তিনি। ইশারায় বসতে বললেন। সালাম ও নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিটন দেওয়ানকে বলা হল, ‘চাকরির বয়স শেষ। যেভাবেই হোক এবার বিসিএস পরীক্ষায় চান্স পাওয়াতেই হবে। সমস্যা শুনে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেললেন লিটন। বললেন, তোর সমস্যা অনেক জটিল। তবে আমি সবাধান দেয়ার অছিলা মাত্র। সব সমাধান দেবেন (উপরের দিকে একটা আঙুল তুলে) তিনি। কোথায় থাকি, নাম পরিচয়, বাবার নাম ইত্যাদি জানতে চাইলেন। এরপর রাশি নির্ধারণের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে আতশি কাচ দিয়ে উল্টেপাল্টে হাত দেখলেন। এরপর বললেন, শনির রাহু গ্রাস করেছে। রাহু কাটাতে নীলার (পাথর) আংটি পরতে হবে। আংটির দাম ১৫ হাজার টাকা। এই আংটি পরলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’
এরপর আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসতেই বাইরে থাকা লিটনের কর্মচারীরা ঘিরে ধরলেন। তাদের বক্তব্য-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ, এখন টাকা দেন, পাথরের আংটি নিয়ে যান।’ এত টাকা সঙ্গে নেই জানিয়ে কিছুক্ষণ পরে আসার কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা গেল।
জানা গেল, প্রতিদিন লিটন দেওয়ানের কাছে গড়ে দেড়শ’ সমস্যাপীড়িত মানুষ সাক্ষাৎ করতে আসেন। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫শ’ টাকা করে শুধু দর্শনী ফি বাবদ দৈনিক আদায় করা হয় ৭৫ হাজার টাকা। মাসের হিসাবে এই অংক সাড়ে ২২ লাখ। বছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় তিন কোটি টাকা। লিটন নিজেই বলেছেন, ৩০ বছর ধরে এই ব্যবসা করছেন তিনি।
প্রলোভনের বিজ্ঞাপন : লিটন দেওয়ানের বিজ্ঞাপনে অনেক নামিদামি চিত্রতারকারা বলেন, তারা ‘দেওয়ান সাহেব’র কাছে এসে উপকৃত হয়েছেন। তাদের অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে।’ এসব চিত্রতারকার মধ্যে আছেন শীর্ষস্থানীয় চিত্রপরিচালক কাজী হায়াৎ, খল অভিনেতা আহমেদ শরীফ, চিত্র নায়িকা রত্না, অভিনেত্রী খালেদা আক্তার, রিনা খান, চিত্রনায়ক হেলাল খান ও অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী।
বিজ্ঞাপন দৃশ্যে চিত্রনায়ক হেলাল খানকে বলতে দেখা যায়, ‘আমাকে উনি (লিটন দেওয়ান) একটা পাথরের আংটি দিয়েছেন। আমি উপকার পেয়েছি। আপনারাও আসুন, আমার মনে হয় উপকার পাবেন।’ বিশিষ্ট অভিনেত্রী রিনা খান বিজ্ঞাপনে বলছেন, ‘জ্যোতিষরাজ লিটন দেওয়ানের কাছ থেকে এই পাথর কিনে ব্যবহার করি। এই পাথর ব্যবহার করার পরে আমার জীবনে সুখশান্তি ফিরে আসে। আপনারাও এই পাথর ব্যবহার করুন। এই পাথর আসল পাথর। জ্যোতিষরাজ লিটন দেওয়ান মানুষের মুখ দেখেই তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন।’ বর্ষীয়ান অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরীকে বিজ্ঞাপনে বলতে দেখা যায়, ‘কোন সমস্যায় কি সমাধান দিতে হবে এটাই তার সাধনা। আপনার সমস্যাগুলো তাকে বলুন। নিশ্চয় আপনি উপকৃত হবেন।’ চিত্রপরিচালক কাজী হায়াৎকে বলতে দেখা যায়, ‘লিটন দেওয়ান একজন নামকরা জ্যোতিষ। তার কাছ থেকে একটি পাথর নিলাম। দেওয়ান সাহেব বললেন, আপনি এই পাথরটি পরবেন। আপনার জীবনে সাফল্য আসবে।’ চিত্র নায়িকা রত্নাকে বলতে দেখা যায়, ‘আমি আমার জীবনের নানা সমস্যা উনাকে (লিটন দেওয়ান) বললাম। সব শুনে তিনি আমাকে দুটি আংটি দিলেন। আংটি দুটি আমি ব্যবহার করছি। এখন আমি অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছি।’ খল অভিনেতা আহেমদ শরীফ বলছেন, লিটন দেওয়ান একজন গুণী ব্যক্তি। তার পিতাও একজন বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। তার পিতার মাজার শরিফের ঔরস অনুষ্ঠানে আমি নিজে যাই। আপনারাও যাবেন। লিটন দেওয়ানের কাছে এসে আমি উপকৃত হয়েছি।’ বিজ্ঞাপন চিত্রে ঢাকায় চলচ্চিত্রের একজন বর্ষীয়ান অভিনেতাকে পাথরের আংটিতে চুমু দিতে দিতে লিটন দেওয়ানের কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। বিজ্ঞাপনের আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, লিটন দেওয়ান একজন সুন্দরী তরুণীর হাত ধরে তার মুখের দিকে চেয়ে বসে আছেন। এ সময় ওই তরুণীকেও লিটন দেওয়ানের দিকে তাকিয়ে রোমান্টিক ভঙ্গিতে হাসতে দেখা যায়।
যা বললেন অভিনেতারা : এসব চিত্র অভিনেতা কি সত্যি উপকার পেয়ে এসব কথা বলছেন? নাকি শুধু টাকার জন্য শেখানো কথাগুলো ক্যামেরার সামনে মডেল হিসেবে অভিনয় করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী বলেন, অভিনয়ই তার পেশা। তবে একটা মান বজায় রেখেই তিনি অভিনয় করেন। লিটন দেওয়ানের বিজ্ঞাপনেও তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অভিনয় করেছেন মাত্র। কিন্তু অভিনয়ের সময় তারা তাকে দিয়ে যা বলাতে চেয়েছিল তার সবকিছু তিনি বলেননি। যেটুকু যৌক্তিক মনে করেছেন সেটুকুই বলেছেন।
অভিনেত্রী রীনা খানের কাছে একই বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি অভিনেত্রী। অভিনয় করাই আমার কাজ। তবে এই বিজ্ঞাপনে তিনি একা নন, আরও অনেকে অভিনয় করেছেন। এ বিষয়টাতে সবাই যে বক্তব্য দেবেন তারও একই বক্তব্য। অভিনেতা হেলাল খান এখন কারাগারে আছেন। তাই তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। চিত্রনায়িকা রত্না প্রশ্নের উত্তরে কোনো সাড়া দেননি। বিদেশে অবস্থান করায় পরিচালক কাজী হায়াতের মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
গ্রেফতারের পর স্বীকারোক্তি : প্রতারণার অভিযোগে ২০০৮ সালের ১৪ আগস্ট লিটন দেওয়ানকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় জাহাঙ্গীর আলম ও শামীম নামের লিটন দেওয়ানের দুই সহযোগীকেও গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়ার পর নিজের সব অপরাধের কথা অকপটে স্বীকার করেন লিটন দেওয়ান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জ্যোতিষ লাইনটা, এই যে পীর ফকিরী এইটা ভণ্ডামি। যারাই করতাছে সব ভণ্ডামি। আমরাও ভুলের কারণে জড়াইয়া গেছিলাম।’ চিকিৎসার জন্য আসা নিঃসন্তান নারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নিঃসন্তান মহিলারা আমাদের কাছে কম আসে। তবে বিভিন্ন বয়সী মহিলারা আমাদের কাছে আসে। অনেক সময় আমাদের সান্নিধ্য পেতেও চায়। আমরাও লোভ-লালসায় জড়ায়ে যাই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই লাইন ছেড়ে দেব। আমি অনুতপ্ত।’ র্যাব-৩ এর তৎকালীন অধিনায়ক উইং কমান্ডার সুলতান মাহমুদ নূরানী সে সময় সাংবাদিকদের জানান, আধ্যাত্মিক শক্তির দাবিদার এই প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছে বহু মানুষ। সে অলৌকিক নানা শক্তি প্রদর্শন করতে পারে বলে প্রচার করত। বলা হতো, তার ঘরের ছাদের ওপর থেকে রক্তের ফোঁটা পড়ে। পরে তাদের তদন্তে দেখা গেল, সে বিশেষ কৌশলে কেমিক্যাল দিয়ে এসব প্রতারণার আশ্রয় নিত।
এদিকে তার প্রতারণার বিষয়ে অনুসন্ধান চলাকালে ১৯ মার্চ লিটন দেওয়ান ফোন করে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘ভাই, নিউজ টিউজ কইর্যা কি হইব? আমি তো একা খাই না। সবাই মিল্ল্যা জুল্ল্যা খাই। একদিন আমার অফিসে আসেন। চা খান।’
বক্তব্য : ১৮ মার্চ লিটন দেওয়ান তার কার্যালয়ে বসে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তিনি এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। প্রতারণা বা ভণ্ডামি করলে তিনি এতদিন টিকে থাকতে পারতেন না। তবে এ দীর্ঘ সময়ে তাকে র্যাব, পুলিশের নানা ধরনের ঝামেলা সহ্য করতে হয়েছে। তিনি দাবি করেন ২০০৮ সালে র্যাব তাকে অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করে। অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ না থাকায় মাত্র ১৬ দিনের মাথায় তিনি জামিনও পান। দায়েরকৃত মামলাও আদালতে প্রমাণিত হয়নি। সব অভিযোগ থেকে তিনি সম্পূর্ণ খালাস পেয়েছেন। টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা তার ব্যবসা। ব্যবসার প্রচার-প্রসার বাড়ানোর জন্য সবাই যেভাবে বিজ্ঞাপন দেয় তিনিও তাই দিচ্ছেন। এটা অন্যায়ের কিছু নয়। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা এভাবে প্রদর্শন করার মধ্যে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা আমাকে হাত দেখিয়েছে তাদের সঙ্গেই আমার ছবি আছে। এতে প্রতারণার কিছু নেই।
কথিত জ্যোতিষরাজ লিটন দেওয়ানের প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, এ ধরনের জ্যোতিষ, জিনের বাদশাকে র্যাব বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করেছে। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে সহজেই তারা জামিনে বেরিয়ে যায়। প্রতারকদের চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট না হতে সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের প্রতারকদের হাতে যারা প্রতারিত হয়েছেন তারা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেবে র্যাব।